নতুন বাস্তবতায় মার্কেটিং

গণমাধ্যম, ইন্টারনেট ও বহিরাঙ্গণ ডিসপ্লে দ্বারা সৃষ্ট বাস্তবতা দেখে এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, সারাক্ষণ সবাই কিছু একটা বিক্রি করতে চাচ্ছে। অনেকেই এই বিক্রয় চেষ্টা বা বিক্রয় প্রসার কার্যক্রমকে মার্কেটিং-এর সমার্থক ভেবে ভুল করছে। তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে বিক্রয় চেষ্টার বাড়াবাড়ি দেখে মনে হয় বিক্রেতার হাত থেকে কোন ভাবেই রেহাই পাওয়া যাবে না, অনেকটা মৃত্যুর মত। প্রকৃতপক্ষে বিক্রয় হচ্ছে মার্কেটিং বা বাজারজাকরণ হিমশৈলের উপরিভাগ মাত্র। সমুদ্রে ভাসমান তুষার স্তুপের যেমন সামান্য অংশ দেখা যায়, বিক্রয় হচ্ছে মার্কেটিং-এর সেই দৃশ্যমান অংশটুকু। বাজারজাতকরণের অনেক কাজের একটি হচ্ছে বিক্রয়, যেটা সবসময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজও নয়। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে অসংখ্য কর্মকান্ডে ব্যাপৃত যার বেশিরভাগকেই মার্কেটিং হিসাবে অবহিত করা যায়। বিনিময় ভিত্তিক যাবতীয় সম্পর্ক স্থাপন ও সেসম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সকল চেষ্টাকেই আজকাল মার্কেটিং বলা হয়। সেটা ব্যবসায় বা মুনাফার জন্য না হলেও চলবে। মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করার সকল চেষ্টাকে আজকাল মার্কেটিং কার্যক্রম হিসাবে পর্যায়ভূক্ত করা হয়। ডিজিটাল বিপ্লব এবং ব্যবসায় পরিবেশের অনবরত দ্রæতলয়ে বদলে যাওয়ার কারণে মার্কেটিং আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে। ব্যবসায়ের অন্যান্য কার্যাবলী যেমন- ফাইন্যান্স উৎপাদন, হিসাব, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সবই অর্থহীন হয়ে যায় যদি কোন প্রতিষ্ঠান তার দ্রব্য, সেবা, অভিজ্ঞতা, ইভেন্ট, ব্যক্তি, স্থান, সম্পত্তি, সংগঠন, তথ্য ও ধারনার জন্য যথাযথ চাহিদা সৃষ্টি এবং/অথবা ব্যবস্থাপনা করতে না পারে, যা থেকে মুনাফা বা ভ্যালু আসবে; যা সবসময় লভ্যাংশ আকারে বন্টনযোগ্য না হলেও চলবে। যার কারণে অন্যান্য ‘সি’-লেভেলের নির্বাহী যেমন- CFO, CIO অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে কোম্পানির প্রধান মার্কেটিং নির্বাহী CMO ।

মার্কেটিং-এ ভুল করার সুযোগ একেবারেই নাই। ভুল করলে পতন অনিবার্য। কিছু দিন আগেও যে সকল কোম্পানি নেতৃত্বে ছিল তাদের কেউ কেই এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। পরিবর্তনের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে চলা, বাজার বাস্তবতাকে অফুরন্ত ধারণ ক্ষমতা দিয়ে গ্রহণ করা এবং নতুন উদ্ভাবন-এই তিন বিষয়ে যারা মনোযোগী হবে তারাই টিকে থাকবে, অন্যথায় বিদায় নিতে হবে। আজ থেকে অর্ধশতাধিক বছর আগে পিটার ড্রাকার বলেছিলেন কোম্পানির প্রথম কাজ হচ্ছে ‘ক্রেতা সৃষ্টি করা’। ক্রেতাই প্রথম। ক্রেতা এবং কোম্পানির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং সেসম্পর্ক স্থায়ী এবং সুদৃঢ় করাই মার্কেটিং-এর কাজ। বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির প্রভাবে বদলে যাচ্ছে সবকিছু, বদলে যাচ্ছে ক্রেতা ও প্রতিযোগিতা। বদলে যাচ্ছে মার্কেটিং-এর ল্যান্ডস্কেপ। একবিংশ শতাব্দীর প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ যেমন-প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন, বিশ্বায়ন, সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা, পরিবেশবাদ ও ভোক্তাবাদের বাড়তি দাবি মোকাবেলা করেই অধিকতর গ্রিণ মার্কেটিং-এর দিকে এগুতে হবে মার্কেটারদের। শতবর্ষ পূর্বে ফরাসি বিপ্লব প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে Charles Dickens তার ‘A Tale of Two Cities’ উপন্যাসে লিখেছিলেন, “It was the best of times; it was the worst of times”। পরিবেশের প্রত্যেকটি পরিবর্তনই একটি সংকট। ম্যান্ডারিন ভাষায় সংকটের জন্য কোন একক প্রতীক নাই। সংকট বুঝাতে তারা দুটি প্রতীক ব্যবহার করে অনেকটাই যুক্তাক্ষরের মত। এর একটি ‘হুমকী’, অপরটি ‘সুযোগ’। পরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুত। আজ গতকালের মত নয়, আগামি কালও আজকের মত হবে না। বলা হয় যেখানে আছ সেখানে থাকতে চাইলেও দ্রুত দৌড়াও। আজকের কৌশল নিয়ে আগামিকাল চলা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। নতুন দিনের কৌশলও হতে হবে নতুন। ভবিষ্যতে আরো নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে, এটা কোন সম্ভাবনা নয়, নিশ্চিত করেই বলা যায়। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের আয়, আয়ু, ভোগ, জ্ঞান ও যোগাযোগ বাড়বে। প্রায় সকলেই মেনে নিয়েছে বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমেই অর্থনীতির মৌলিক সমস্যার সমাধান হবে যদিও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে এ ব্যবস্থার সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়। বাজার ব্যবস্থায় যারা আস্থাশীল তাদের মতে, ঐ বাজারই সবচেয়ে ভাল যেখানে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী বাজারে পণ্য বা সেবা পাবে, আর কোম্পানিও তার ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী পণ্য-সেবা সরবরাহ করে সন্তষ্টি দানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা বা লক্ষ্য অর্জন করবে। ‘বিগ ডাটার’ ব্যবহারের মত সাম্প্রতিক সময়ের পরিবর্তনগুলো নিয়ে এসেছে অফুরন্ত সুযোগ। এগুলোকে সমস্যা হিসাবে প্রত্যক্ষণ করলেও ক্ষতি নেই। কারণ প্রত্যেকটি সমস্যার পিছনেই লুকিয়ে থাকে একটি সুযোগ। সুযোগ খুঁজতে প্রয়োজন সৃজনশীলতা। অনেক সফল ব্যবসায়ীর নাম করা যাবে যারা কোন দিন মার্কেটিং শাস্ত্রটি পড়েনি। Philip Kotler-এর নাম পর্যন্ত শুনেনি। ব্যয়বহুল গবেষণা, গণবিজ্ঞাপন, বৃহৎ বিক্রয় বাহিনী-এর কোনটাই ব্যবহার করেনি, অথচ তারা সফল মার্কেটার। সীমিত সম্পদ নিয়ে ক্রেতার খুব কাছে অবস্থান করে, তাদের প্রয়োজনের সবচেয়ে সন্তোষজনক সমাধান দিচ্ছে অনেক কোম্পানি। অনেক কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত সনাতন মার্কেটিং-এর সকল প্রথা ভেঙ্গে সফল হচ্ছে। বই পুস্তকে সুপারিশকৃত পথ (STP’, 4Ps, ব্র্যান্ডিং) না মাড়িয়ে সৃজনশীল পথে সফলতা এনেছে। অনেক সফল কোম্পানি আছে যারা ব্যয়বহুল গবেষণা ও বিজ্ঞাপনে একেবারেই সময় ও অর্থ বিনিয়োগ না করে ক্রেতা ক্লাব প্রতিষ্ঠা, সৃজনশীল গণসংযোগ, ক্রেতাবান্ধব ভ্যালু ডেলিভারি পদ্ধতি এবং দীর্ঘ ক্রেতা আনুগত্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়েছে। সফল হতে হলে সবাইকে ‘P&G’ বা Unilever-কে অনুসরণ না করলেও চলবে। যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে অন্তউদ্যোগী বাজারজাতকরণ (Intrepreneurial Marketing)। অন্তউদ্যোগী বাজারজাতকরণ হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের ফর্মূলার সাথে (Formulated Marketing) সৃজনশীলতার কার্যকর মিশ্রন। সৃজনশীল ব্যক্তিরা মেধার উপর নির্ভর করেই বাঁচে। তারা সুযোগের পূর্বানুমান করতে পারে এবং নিজকে তার সাথে জড়িয়ে ফেলে। সৃজনশীলতা একটি নিরন্তর প্রচেষ্টা। কেবলমাত্র মার্কেটিং বই পড়ে সেটা অর্জন সম্ভব নয়। জ্ঞানের রাজ্যে উদ্দেশ্যহীন অক্লান্ত ভ্রমণকারীরাই বেশি সৃজনশীল হয়। নতুন বাস্তবতায় সূত্রবদ্ধ মার্কেটিং (Formulated Marketing) ব্যবহার করে এখনও হয়ত কেউ কেউ টিকে আছে তবে আশংকা তারা সহসাই পথ হারাবে। অধিকতর সৃজনশীলতার অনুশীলনের মাধ্যমে উদ্ভাবনই হচ্ছে আগামি দিনের মার্কেটিং (Marketing Next)।


অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 


This article was published in the publication of Bangladesh Marketing Day 2019. 

Share this article
Shareable URL
Prev Post

If Himalayas are Marketing then Everest is its Sales

Next Post

Success Tips for the Aspiring Marketers

Read next

ব্র্যান্ড প্র্যাক্টিসনার্স বাংলাদেশ এর ব্র্যান্ডিং বিজনেস সেসান এবং ডায়ালগ ১৭ জানুয়ারী

আগামী ১৭ জানুয়ারী ২০২০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে ব্র্যান্ড প্রাক্টিসনার্স বাংলাদেশ আয়োজিত ওয়ালটন রেফ্রিজারেটর…
0
Share