Marketing

‘তোমার ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও’ বনাম ওয়ানপ্লাসের সাফল্যের তর্জমা

Proloy Hasan

'তোমার ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও' বনাম ওয়ানপ্লাসের সাফল্যের তর্জমা 1Photo Source: Dribbble

সম্প্রতি অনলাইনে আত্নপ্রকাশ করা মোটোরোলার পুরনো ফ্ল্যাগশিপ মডেল ’রেজর’এর নতুন সংস্করণটা দেখলাম, এটি ২০২০ সালের জানুয়ারি, মানে আর মাস দেড়েক পর বাজারে পাওয়া যাবে! ধুকেঁ ধুকেঁ টিকে থাকা মটোরোলা জাস্ট তাদের ভাজঁ খুলেই যদি মনে করে ক্রেতাদের বিস্তর আনন্দ দেখিয়ে ফেলেছে, অর্থাৎ কিনা, একটা ফোলডিং ডিসপ্লে এনে যদি মনে করে, তারা তাদের নতুন মোবাইল ফোনের উদ্ভট মূল্যকে (দেড় হাজার ডলার) যৌক্তিকতা দিতে পেরেছে, তাহলে বলবো তারা নির্ঘাত বোকার স্বর্গে বাস করছে। ইতিমধ্যেই টেকপাড়ায় এই নিয়ে ঢি ঢি পড়ে গেছে। এই বিশাল প্রাইস ট্যাগকে সাপোর্ট দেবার মত শক্ত প্রযুক্তিগত ব্রেকথ্রু এতে নেই বলেই মনে হয়েছে,  যদিও তারা দাবী করেছে এই ভাজঁ করা স্ক্রিন আবিস্কার ও বাজারজাত করণের উপযোগী করতে তাদের প্রায় ৪ বছর লেগেছে!

'তোমার ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও' বনাম ওয়ানপ্লাসের সাফল্যের তর্জমা 2

তবে এটা ঠিক যে, বাজারের যে বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো (স্যামাসং, এলজি, হুয়াউয়ে) ফোলডিং স্ক্রিনের জাদু দেখাতে চেয়েছে, তাদের ভেতর এরাই প্রথম এটিকে বাজারে ছাড়তে পেরেছে।

প্রায় ২ দশক পরে বাজারে এসে হুট করেই আপাতঃ দুর্বল একটা পণ্যের এই রকম আকাশচুম্বি প্রাইস ট্যাগ নিয়ে মাঠে নামাটা মোটোরোলার জন্য আত্নঘাতি হতে পারে। কারণ ২ দশকে মার্কেট আর প্রযুক্তি প্রচন্ডরকম বদলেছে, সেই সাথে বেড়েছে কম্পিটিটর!

প্রসঙ্গত ওয়ানপ্লাসের কথা বলি। গতকাল রাতে চাইনিজ মোবাইল ব্র্যান্ড ”ওয়ানপ্লাস” এর মার্কেটিং স্ট্রাটেজি পড়ছিলাম, How the OnePlus’ marketing strategy made it the most desirable phone in the world?  কয়েক বছর আগের পোষ্ট, তবু রিলেভেন্ট। অনেকগুলা কেস স্টাডি আছে এই রকম। অনেকেই জানেন, ভারতের মার্কেটে ওয়ানপ্লাস মুটামুটি বাজারে নেমেই বাজিমাত করে ফেলেছিলো। এর কারণ উদঘাটন করতে অনেক বাঘা বাঘা মার্কেট গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিরিয়াসলি গবেষণা করা শুরু করলো। কারণ, ভারতের মোবাইল বাজার হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে মারত্নকরকম প্রতিদ্বন্দীতামূলক বাজারের একটা। সেখানে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডকে এত কম সময়ে টেক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা পৃথিবীর কোন ব্র্যান্ডের পক্ষেই সহজ কাজ ছিলো না।

'তোমার ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও' বনাম ওয়ানপ্লাসের সাফল্যের তর্জমা 3

তো এনালাইসিসগুলা পড়ে আমি ভারতীয় উপমহাদেশে ওয়ানপ্লাসের সাফল্যের কিছু সারমর্ম দাড়ঁ করিয়েছিঃ

১) প্রতিযোগিতামূলক মূল্যঃ কম্পিটিটিভ প্রাইসিং ছিলো ওয়ানপ্লাসের মূল অস্ত্র, এ কথা মুটামুটি সব কয়টা এনালিটিক্যাল রিভিউতেই বলা হয়েছে। প্রডাক্টের মান খারাপ করে দাম কমায়নি, কম্পিটিটিভ প্রাইসিং মানে প্রডাক্ট কোয়ালিট অক্ষুন্ন রেখে কিংবা বাড়ানো সত্ত্বেও দাম কম রাখা। ওয়ান প্লাসের হাই এন্ড ফোনের দাম বাজারের অন্য হাই-এন্ড মোবাইলের চাইতে কম। অনেকে খেয়াল করে থাকবেন যে, অনেক নামী দামী ব্র্যান্ড ভারতীয়দের জন্য একই সিরিজের কম দামী একটা মডেল বের করে, ওয়ানপ্লাস মার্কেট রিসার্চ করে দেখেছে যে, এই বিষয়টাকে ভারতীয়রা ভালো ভাবে নেয় না। তাই তারা গ্লোবাল ভার্সনটাই ভারতীয়দের জন্য কম দামে ছেড়েছে, আলাদা মডেল বের করে বেহুদা সেগমেন্টাইজ করেনি। ফলশ্রুতিতে, সেল বেড়েছে রাতারাতি! তাতে প্রাথমিকভাবে লোকসান হলেও হাই সেলস ভলিউমের কারণে ওয়ানপ্লাস খুব দ্রুত ব্রেইক ইভেন পার করে লাভের মুখ দেখতে শুরু করে!

২) ইনভাইটেশন অনলিঃ শুরুর দিকে শুধুমাত্র দাওয়াত করে আনা কাস্টমাররাই তাদের ফোন কিনতে পারতো। এটা জাস্ট এক ধরনের গ্রোথ হ্যাংকিং মার্কেটিং পলিসি, খুব দ্রুত ও হঠাৎ করে বাজারে একটা হাইপ তৈরী করা, তারপর সেটার উপর ভিত্তি করে সেলস ও WOM বাড়ানো।

এই পদ্ধতি জিমেইল প্রথম চালু করেছিলো, মনে আছে শুধু শুরুর দিকে গুগল শুধুমাত্র ইনভাইটেশন অনলি রেখেছিলো জিমেইলকে? মানে শুধুমাত্র যাকে আমন্ত্রন জানানো হবে সেই জিমেইলের একাউন্ট খুলতে পারবে। সুতরাং, সে সময় কারো একটা জিমেইল আইডি থাকার মানে সে নিজেকে ”মুই কি হনু রে” ভাবতে পারতো। এর ৩ বছর পর জনসাধারনের জন্য জিমেইল খুলে দেয়া হয়।

এই ৩ বছরে গুগল তাদের এই ই-মেইল সার্ভিসটাকে আরো বেটার করেছে, আরো বাগ-ফ্রি করেছে, মেইল-সার্ভারগুলোকে আরো শক্তিশালি করেছে কারণ সে সময় ইউজার বেস হুহু করে বাড়ছিলো! এই উদাহরণটা রায়ান হলিডে তার বিশ্বখ্যাত ”গ্রোথ হ্যাকার মার্কেটিং” বইয়ের শুরুর দিকেই উল্লেখ করেছেন।

গুগল থেকে শুরু করে আমাজন, উবার, এয়ারবিএনবি, ড্রপবক্স, ইবে, মিডিয়াম – সিলিকন ভ্যালির প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠিত স্টার্টাপ কোন না কোন সময়ে অতি অবশ্যই-অবশ্যই গ্রোথ হ্যাকিং এর হেল্প নিয়ে বড় হয়েছে, তা যত মিলিয়ন ডলার ফান্ডিংই তারা পাক না কেন। বিষয়টা এতটাই ইন্টারেস্টিং আর মজার যে, আমি ভাবছি এটা নিয়ে আলাদা করে কয়েক পর্বের পোষ্ট লিখবো।

৩) নীশ টার্গেটঃ নীশ অডিয়েন্সকে লক্ষ্য করে বাজারে ছাড়া হয়েছিলো। যারা টেকি গিক, তারা ওয়ানপ্লাস ব্যবহার করে- এইরকম একটা সুনাম তারা বাজারে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, যেটা আর কোন ফোনের ব্র্যান্ড পারে নাই।

৪) ডিজিটাল ও কনটেন্ট মার্কেটিংকে যথাযথ লেভারেজঃ এই বিষয়টা নিয়ে রীতিমত গ্রাফ চার্ট করে বোঝানো হয়েছৈ আর্টি‍কেলে। কম্পিটিটর এনালাইসিসসহ। কিভাবে তাদের ওয়েব সাইট ট্রাফিক বাড়ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রেজেন্স বাড়ছে সব কিছু। অনেকে বড় বড় মার্কেট বিশ্লেষকদের ধারনা, ওয়ানপ্লাসের এই দ্রুত সফলতার পেছনে সোশ্যাল মিডিয়াকে ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করতে পারার অবদান রয়েছে সিংহভাগ।

উপরের সবগুলোকে তারা খুবই বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে কম্পাইল্ড করা হয়েছৈ তাদের প্রতিটা এড ক্যাম্পইনে। বাজারে প্রতিটা প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডকে ওয়ানপ্লাস বিদ্রুপ করেছে। কিভাবে করেছে সেটা বুঝতে হলে তাদের এই এডটি দেখুনঃ

'তোমার ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও' বনাম ওয়ানপ্লাসের সাফল্যের তর্জমা 4
স্যামসাং, এইচটিসি, মোটোরোলা, আপেল, ব্লবেরি, উইন্ডোজ – বাদ যায়নি কেউ!

তবে অনেকে বলেছেন, ওয়ানপ্লাস শাওমিকে গোনায় ধরে না।  যুদ্ধবিদ্যায় খুব পুরনো একটা প্রবাদ আছে – নেভার আন্ডারএস্টিমেট ইওর এনিমি। উক্ত এডেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শাওমিকে নিয়ে ওয়ানপ্লাস কিছু বলেনি, মানে শাওমিকে সে হিসাবের মধ্যেই রাখেনি। শাওমির যে আগ্রাসী বিজনেস গ্রোথ সমগ্র এশিয়া ‍জুড়ে, তাতে করে আমার মনে হচ্ছে, অদূর ভবিৎষতে ওয়ানপ্লাসকে খুব চড়া দামে এই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মূল্য চুকাতে হবে, যেমনটা নোকিয়া চুকিয়েছে এন্ড্রয়েডকে গোনায় না ধরে।

যা বলছিলাম, মোটোরোলার উচিত হবে, তাদের নতুন পন্যটা এই উপমহাদেশের বাজারে ছাড়ার আগে অন্তত ওয়ানপ্লাসের কেইস স্টাডিটা ভালো করে পড়াশোনা করে নেয়া। নাহলে তারা আবারো ফ্লপ খাবে, এবং আবারো হয়তো এক-দেড় দশকের জন্য উধাও হতে হবে!


'তোমার ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও' বনাম ওয়ানপ্লাসের সাফল্যের তর্জমা 5

Proloy Hasan

Brand Marketing Personal | Content Marketer | Creative Writer | Blogger | Storyteller | Sci-fi Snob.

I’m a youthful, funny and lively person to meet with. I’m passionate about writings, feel so comfortable to introduce myself as a freelance blogger since 2006. If you want to say ‘hello’, knock me on www.linkedin.com/in/proloyhasan/


এডস অব বিডি ব্লগে এটা আমার প্রথম লেখা। মার্কেটিং নিয়ে ব্র্যান্ড প্র্যাকটিশনার্স ফেসবুক গ্রুপে নিয়মিত লেখালেখি করার চেষ্টা করি। খুব শীঘ্রই আমার পুরনো লেখাগুলোও এই ব্লগে নিয়ে আসার চেষ্টা থাকবে। সেই সাথে আশাকরি, পাঠকরা আমার বানানভুলগুলোসহ অন্যান্য ভুলগুলোও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, এবং ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন।। গঠনমূলক সমালোচনা সুস্বাগতম।

Proloy Hasan
the authorProloy Hasan
Brand Analysis and Content Marketing Specialist. Author নন-মার্কেটারদের জন্য মার্কেটিং